এখন থেকে ৮১ বছর আগে বরিশাল জিলার কাশিপুর ইউনিয়নের চহঠা গ্রামে আমার জন্ম হয় এক গরীব চাষার ঘরে। পশ্চিম দেশের ছেলে মেয়েরা ছোট বয়স থেকেই অনেক স্বপ্ন দেখে। তারা স্বপ্ন দেখে প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার, য়্যাস্ট্রোনাট, ডাক্তার অথবা আইনজীবী হওয়ার। আমার ছোট বয়সে একটাই স্বপ্ন ছিল, সেটা ছিল বেঁচে থাকা। আমি আশেপাশে দেখতাম মৃত্যু আর মৃত্যু। আমাদের গ্রামের অর্ধেক মুসলমান ছেলেমেয়েরা মারা যেত তাদের পাঁচ বছর বয়স হওয়ায় আগে। আমার নিজের ভাই বোনদের ভেতরেও মারা গেল ৫০ শতাংশ। আমার মা মারা গেলেন আমার একটা বোনের জন্মের দুই তিন দিন পর। মৃত্যুর আগে ডাক্তার অথবা ঔষধ তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। দুনিয়ায় কেউ জানলোনা কেন তিনি মারা গেলেন। এর কয়েকদিন পরে একইভাবে মারা গেল আমার একটা তিন বছর বয়সের ছোট ভাই। মাঝে মাঝে কলেরা–বসন্ত এসে নিয়ে যেত গ্রামবাসীর একটা বড় অংশের মানুষকে। আল্লাহর কি ইচ্ছা, তিনি আমাকে বাঁচিয়ে রাখলেন।
আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান। আল্লাহ ছুবাহানাহু তা’য়ালা’ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তিনি আমাকে দিয়েছেন ক্যানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি, পূর্ব ও পশ্চিম দেশে ৪০ বছরের বেশি সময় অধ্যাপনা করার সুযোগ, আমার ক্যানাডার ব্যবসায় সফলতা, আমার ছেলের ডাক্তার হিসাবে জগৎব্যাপী খ্যাতি, আমার নাতি–নাতনিদের উত্তর আমেরিকার নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া, আরো কত কি। প্রথম জীবনে চলার পথে আমি অনেক বাধাবিপত্তির সম্মুখিন হয়েছি। আমার বিপদের সময় কয়েকজন বড়ো হৃদয়ের মানুষ আমাকে সাহায্য করেছেন। তাঁদের ভেতর আমার নানা নূর হোসেন শরীফ, চাচা এলেমউদ্দিন আহমদ ও চাচা শিল্পী আব্দুল লতিফের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সারা জীবন আমি কাজ করে এসেছি। আমার বয়স ৮০ বছর হলেও আমি প্রত্যেক দিন ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা কাজ করি। আমি এখনো ১৪ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে মন্ট্রিয়াল থেকে আমার ছেলের বাড়ি আমেরিকার ম্যারিল্যান্ডে বেড়াতে যাই। আমি আল্লাহ ছুবাহানাহু তায়া’লা’কে ধন্যবাদ জানাই যে তিনি আমাকে অনেক রকম কাজ করার ক্ষমতা দিয়েছেন। পাঁচ হাজার লোকের সামনে বক্ত্রিতা দিতে আমার কোনো অসুবিধা হয়না। আমি বইপত্র লিখি। যখন দরকার হয় তখন আমি আবার আমার ভাড়াটে লোকদের বাড়ির টয়লেটও পরিষ্কার করি। আমার কাছে ছোট বড় কাজে কোনো প্রভেদ নাই। তবে প্রথম জীবনে আমার কতগুলো কাজ করতে খুব কষ্ট হতো। আজ সেই কাজগুলো সম্বন্ধে কয়েকটা কথা বলতে চাই।
পাঁচ/ছ’ বছর বয়স থেকেই গরু চরানো ও ক্ষেত খামারের অন্যান্য ছোট ছোট কাজ করতে শুরু করি। ১০–১১ বছর বয়স থেকে আরম্ভ করি চাষাবাদের অন্যান্য কাজ। সপ্তাহে ৬ দিন সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে আমাদের খড়ের রান্নাঘরে মাটির মেঝের উপর একখানা কাঠের পিঁড়িতে বসে মাটির তৈরি বাসন অথবা খোরা থেকে পান্তাভাত খেতাম। বেশিরভাগ সময়ই একটা পিঁয়াজ আর দুই তিনটা পোড়া মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া শেষ করতাম। এর পর লাঙ্গল ও জোয়াল কাঁধে করে গরু দুটো নিয়ে হাল চাষ করতে মাঠে যেতাম। বেলা ন’টার দিকে বাবা এসে লাঙ্গল ধরতেন এবং আমি দৌড়ে বাড়ি গিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পরে গোছল করে সামনে–খোলা লুঙ্গি এবং একটা হাত–কাটা গেঞ্জি পরে কাশিপুর হাইস্কুলে যেতাম। বলা বাহুল্য যে আমি খালি পায় স্কুলে যেতাম। বিকেল চারটার সময় বাড়ি ফিরে আবার মাঠে যেতাম বিভিন্ন রকমের কৃষিকাজ করতে। সূর্যাস্তের পূর্বে গরু দুটো নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। রোববার ও অন্য সময় যখন স্কুল ছুটি থাকতো তখন দুপুরে দু’এক ঘণ্টা বিশ্রাম নেয়া ছাড়া সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্ষেত খামারের কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকতাম। গ্রীষ্মের সময় দুপুরে আমাদের বাড়ির পাশের বড়ো তেঁতুল গাছটার ছায়ায় ঘাসের উপর শুয়ে কিছুণ বিশ্রাম নিতাম। মাঝে মাঝে পিঁপড়াগুলো কানে ঢুকে বিরক্ত করতো।
যাঁদের চাষাবাদ সম্বন্ধে জ্ঞান আছে তাঁরা জানেন যে পৌষের ধান কাটার পর মাটি যখন নরম থাকে তখন লাঙ্গল দিয়ে সেই মাটি উল্টিয়ে দেওয়া সহজ। কিন্তু তখন জমি চাষ করার ফলে চাকাগুলো খুব বড়ো থাকে এবং অতি অল্প সময়ের ভেতর সেগুলো শুকিয়ে প্রায় পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। এই জমিতে বীজ বপন বা গাছের চাড়া লাগাতে হলে চাকাগুলোকে ভেঙে ছোট ছোট টুকরা করে ফেলতে হয়। গরুর সাহায্যে মই দিয়ে এই চাকাগুলো ভাঙা সম্ভব হয়না। তাই আমি এগুলিকে একটা একটা করে কাঠের মুগুর দিয়ে পিটিয়ে গুঁড়ো করতাম। একটা ছোট জমিতেও হাজার হাজার চাকা থাকতো। আমাকে দিনের পর দিন চাকা ভাঙতে হতো। এ কাজ শুরু হওয়ার দু’এক ঘণ্টার মধ্যেই আমার হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। সেই ফোস্কা হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুগুর পিটাতে আমার অনেক কষ্ট হতো।
আষাঢ় মাসে সামান্য পানিসহ জমি চাষ করে মই দিয়ে সমান করে আমি বীজধান ছিটিয়ে বপন করতাম। অনেক সময় এই বীজধানের মাঠ বৃষ্টির পানিতে ডুবে যেত। তাড়াতাড়ি করে এই পানি সেঁচে সরিয়ে না ফেললে বীজধানগুলো নষ্ট হয়ে যেত। সুতরাং গামলা দিয়ে আমাকে সেই পানি সেঁচে ফেলতে হতো। কখনো কখনো একটা জমির পানি সেঁচে ফেলতে আমাকে একটানা দু’দিন কাজ করতে হতো। এ কাজটা আমার কাছে খুব কষ্টকর মনে হতো।
বর্ষার মৌসুমে আমাকে অনেক সময় হাল চাষ করতে হতো এক হাঁটু অথবা তার চাইতেও বেশি পানির ভেতর। পা দিয়ে অনুভব করতে হতো জমির কোন অংশ চাষ করা হয়েছে এবং কোন অংশ চাষ করা হয়নি। পানির ভেতর জমি চাষ করতে আমার দু’টো অসুবিধা ছিল। প্রথমত,বড়ো বড়ো কালো জোঁকগুলো আমার শরীরের রক্ত চোষার জন্য আমাকে অনুসরণ করতো। সেগুলো যখন আমার শরীরের রক্ত চুষতো তখন সেগুলোকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে টেনে ছুড়ে ফেলা খুব কষ্ট হতো। তাই আমার কাছে কিছু লবণ রেখে দিতাম। জোঁকের মুখের উপর লবণ দিলেই সেটা আমার শরীর থেকে পড়ে যেত। দ্বিতীয়ত, জমিগুলো ছিল জলাবদ্ধ। তাই সেখানকার পানি ছিল দূষিত। ফলে যতক্ষণ সেই পানির ভেতর থাকতাম ততক্ষণ সারা শরীর চুলকাতো। একই সময় জোঁকের উপদ্রপ ও শরীর চুলকানিতে আমি ছটফট করতাম।
বর্ষার ঋতুতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পাদুটো কাদা–মাটি–পানির ভেতর থাকায় পায়ের পাতা ও আঙ্গুলগুলোর মাঝখানটা রক্তমুখী হয়ে থাকতো। কারণ প্যাকওয়া নামে একটা ব্যাকটেরিয়া পায়ের এই অংশগুলো খেয়ে ফেলতো। এই পা নিয়ে হেঁটে যখন বেগুন অথবা অন্য কোনো তরকারির ভারী ঝুড়ি মাথায় নিয়ে প্রায় চার মাইল দূরে বরিশাল শহরের বাজারে বিক্রি করতে যেতাম তখন প্রত্যেক পদক্ষেপে ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করতো। বরিশালের রাস্তা ছিল ইটের সুরকির তৈরী। অনেক বৃষ্টির ফলে এই সুরকিগুলো প্রায় চাকুর মতো ধারালো হয়ে যেত। আমার শরীর ও ভারী বোঝার ওজনের ফলে ধারালো সুরকিগুলো যেন আমার রক্তমুখী পা দুটোকে কেটে ফেলতো। মাঝে মাঝে রাতে পায়ে নীল রংয়ের তুঁতীয়া নামে একটা ঔষধ ব্যবহার করতাম। এই ঔষধ ব্যবহার করার পর মনে হতো পা দুটো যেন পুড়ে যেত ও অসহ্য ব্যথা হতো। এই ঔষধ ব্যবহারের ফলে পা দুটো দু’চার দিন ভালো থাকতো।
ধান, খড় বা জ্বালানি কাঠের বেশি ভারী বোঝাগুলো বেশ দূর থেকে মাথায় করে বাড়ি আনতাম। এতে যে দৈহিক কষ্ট হতো তা বলা বাহুল্য। কিন্তু এ কাজে আমার একটা মানসিক সমস্যা হতো। আমার মনে হতো যে মাথায় অতো ভারী বোঝার চাপে আমার সব বুদ্ধি নষ্ট হয়ে যাবে। আমি এখন জানি যে মাথায় ভারী বোঝা বহন করলে বুদ্ধি নষ্ট হয়না। কিন্তু সেই সময় আমার কাছে এ চিন্তাটা ছিল অতি উদ্বেগজনক। আমার আরো একটা বড়ো মানসিক সমস্যা ছিল। আমি অ্যারোপ্লেনকে খুব ভয় পেতাম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আমাদের এলাকার উপর দিয়ে অনেক অ্যারোপ্লেন উড়ে যেত। একদিন একটা অ্যারোপ্লেনে আগুন লেগে আমাদের বাড়ির কাছে পড়ে গিয়েছিলো। আর একদিন আমাদের মাথার উপর দিয়ে অনেকগুলো ব্রিটিশ অ্যারোপ্লেন একটা জাপানিজ অ্যারোপ্লেনকে ধাওয়া করে যাচ্ছিলো। আমি যখন অনেক বড়ো খোলা মাঠে একা হালচাষ, ধান কাটা অথবা খেতখামারের অন্য কোনো কাজ করতাম তখন দূর থেকে অ্যারোপ্লেন আসার শব্দ শুনলেই ভয়ে দৌড়িয়ে গিয়ে একটা গাছের নিচে পালিয়ে থাকতাম। আমি মনে করতাম যে আমাকে না দেখলে পাইলট আমার উপর বোমা ফেলতে পারবেনা, অথবা প্লেনটা আমার উপর ভেঙে পড়লে গাছটা আমাকে রক্ষা করবে। প্লেনটা যাতে তাড়াতাড়ি আমার মাথার উপর থেকে চলে যায় তার জন্য আমি একটা দোয়া পড়তাম। একদিন আমাদের বাড়ির ছকিনা বেগম লক্ষ্য করলেন যে আমি প্লেন আসার সাথে সাথে বিড়বিড় করে কি যেন পড়ছিলাম। তখন আমাদের বাড়ির অনেক লোক উঠানে উপস্থিত ছিল। ছকিনা বেগম সবাইকে বলেই দিলেন, “দ্যাহেন, রব য্যানো বিড়বিড় করয়্যা কি পড়তেছে!”
আমার আর একটা কষ্টের কথা বলে আমি এই লেখাটা শেষ করবো। আমার রাত্রে বিছানায় ঘুমানো ব্যাপারটা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। আমি ঘুমাতাম মাটির মেঝেয় সরাসরি হোগলার উপর। অর্থাৎ হোগলার উপর চাদর বা অন্য কোনো কাপড় চোপড় ছিলোনা। আমার বালিশের কোনো কভার ছিলোনা। বালিশটার বয়স কত বছর ছিল তা আমার জানা ছিলনা। পাঠক বুঝতে পারছেন সেই বালিশটার অবস্থা কিরকম ছিল। আমাদের কখনো মশারি ছিলোনা। সুতরাং ঘুমানোর পর প্রত্যেক রাতে দুটো জীব আমার রক্ত খেয়ে পার্টি করতো। আমার শরীরের নিচে হোগলা থেকে এসে আমার রক্ত খেত ছাড়পোকাগুলো, আর উপরের অংশটা থেকে গান গেয়ে রক্ত খেত মশার ঝাঁক। ভোর বেলা আমার সারা শরীরে দেখা যেত লাল রঙের ছোট ছোট দাগ এবং ছোট ছোট ফোলা জায়গা। এই দু’টা জীবের উপদ্রপে আমি রাত্রে বিছানায় শুতে ভয় পেতাম। মশার কামড়ের ফলে আমার ম্যালেরিয়া জ্বর লেগেই থাকতো। বলা বাহুল্য আমার ভাগ্যে তখন চিকিৎসা জোটেনি।
আমি আশা করি যে পাঠক আমার এ লেখাটা থেকে গরীব চাষাদের দুঃখ কষ্ট সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা করতে পারবেন।