কামিলের পিতামাতারা তাদের তিনটি সন্তানকে ক্যানাডার সেরা প্রাইভেট স্কুল ও কলেজ, এবং ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কামিল তাদের দ্বিতীয় সন্তান। এখন সে টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমমিউনোলজিতে মাস্টার্স ডিগ্রি করছে। তার বর্তমান প্রোগ্রাম সমাপ্ত হলে সে হয় ডাক্তার হওয়ার জন্য একটি মেডিক্যাল স্কুলে যোগদান করবে, অথবা সে তার পি এইচ. ডি ডিগ্রি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করবে। আমার মন্ট্রিয়ালের বাড়ি থেকে টরোন্টো ৫৪১ কিলোমিটার দূরে। কামিল আমাদের নাতি। আমাকে ও আমার স্ত্রীকে সে প্রায়ই ফোন করে আমাদের খোঁজখবর নেয়ার জন্য । সে আজ সকালে আমার সাথে কথা বলার জন্য ফোন করেছিল। যেহেতু আমাদের কথোপকথন কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল, আমি তাই এটি লিখে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কামিল এবং তার ভাইবোনরা আমাকে নানু বলে ডাকে।
প্রাথমিক গ্রিটিংসের পর কামিল আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ” নানু, আজ সকালে আপনি কটায় ঘুম থেকে উঠেছেন ?” আমি উত্তর দিলাম,
” সাড়ে ছ’টায় ” ।
কামিল, “আপনি কি প্রত্যেক দিন এত সকালে ঘুম থেকে উঠেন?
নানু: “হ্যাঁ, আমি খুব সকালেই উঠি। প্রথমতঃ, ফজরের নামাজ পড়ার জন্য সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠতে হয়। দ্বিতীয়ত, ৭৬ বছর আগে আমার দশ বছর বয়স থেকেই কৃষকের ছেলে হিসাবে আমার সকালে উঠার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল। আমি সূর্যোদয়ের অনেক আগে ঘুম থেকে জেগে উঠতাম। তারপর মাটির বাসন থেকে কাঁচা পিয়াজ ও পোড়া মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে আমার কাঁধে লাঙ্গল ও জোয়াল বহন করে বলদ দুটোকে নিয়ে মাঠে হাল চাষ করতে যেতাম। বেলা ১টা ২টা পর্যন্ত জমি চাষ করতাম।”
কামিল: “তার পর কি করতেন ?”
নানু: “তারপর বাড়ি ফিরে এসে আমি বলদগুলোকে দড়ি দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে রেখে তাদের খাবার জন্য পানি ও খর সরবরাহ করতাম । এরপর বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আমি আমাদের বাড়ির পাশের তেঁতুল গাছটার শীতল ছায়ায় শুয়ে পড়তাম।”
কামিল:”কিসের উপর শুতেন ?”
নানু: আমি গাছের তলায় ঘাসের উপর শুতাম । যেহেতু আমি মাঠে অনেক ঘন্টা কাজ করে খুব ক্লান্ত থাকতাম, প্রায়শই আমি ঘাসের উপর ঘুমিয়ে পড়তাম। তখন বড় এবং কালো পিঁপড়াগুলো আমার কানে ঢুকে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতো।”
কামিল: “আপনি আপনার চারপাশে ভিনিগার ছড়িয়ে দিতেননা কেনো? ভিনিগার দিলেতো আপনার কাছে আর পিঁপড়া আসতোনা। “
নানু: “আমিতো সেই সময় ভিনিগার নামটাও শুনিনি। তখন থেকে আঠারো বছর পর আমার বয়স যখন আঠাশ বছর তখন ক্যানাডায় এসে আমি প্রথম ভিনিগার সম্বন্ধে জেনেছি। অন্য কোনো পিঁপড়া ।প্রতিরোধক কেমিক্যাল সম্বন্ধেও আমার জ্ঞ্যান ছিলোনা। আর জ্ঞ্যান থাকলেইবা কি হতো ? আমরাতো তা কিনতে কিনতে পারতামনা। । আমরা ছিলাম অত্যন্ত গরিব। আমাদের পয়সা করি ছিলনা। আমি গামছা পরে মানুষ হয়েছি। আমাদের ক্ষেতে যে ধান উৎপন্ন হতো তাতে আমাদের আট মাস চলে যেত। তাই আমাদের ঘরে চার মাস দুর্ভিক্ষ ছিল। এই সময়ে আমরা প্রায়সই জঙ্গল ও পুকুর থেকে সংগ্রহ করা শাক-সবজি খেয়ে বাঁচতাম। আমি নিজে কচু শাক, ঢেকি শাক, কলমি শাক ইত্যাদি সংগ্রহ করতাম। আমরা মাঝে মাঝে সিদ্ধ মিষ্টি আলু খেতাম। এখন শুনি যে এই শাক-পাতাগুলো এবং মিষ্টি আলু অত্যন্ত পুষ্টিকর। এগুলি খেয়েছি বলেই হয়তো আমি এখনো বেচে আছি। তুমি এখন বুঝতে পারো আমি মাছ ধরতে পারদর্শী কেন। আমাদের খাদ্যে প্রোটিন সরবরাহ করার জন্য আমাকে প্রায় প্রতিদিনই মাছ ধরতে হতো।”
আমার কথাগুলো শুনে কামিল অভিভূত হয়ে গেলো। সে বললো:
“নানু, আপনি একজন অত্যন্ত ভাগ্যবান মানুষ, কারণ আপনি অনেক দুঃখ কষ্টের ভেতর বড়ো হয়েছেন। আমি দুঃখিত যে আমার দুঃখ কষ্টের ভেতর জীবন যাপন করার সুযোগ হয়নি। আমি যদি আপনার মতো কষ্টের ভেতর দিয়ে মানুষ হতাম তাহলে আমি একজন আরো বেশি ভালো মানুষ হতে পারতাম; আমি অন্য লোকেদের দুঃখকষ্টগুলি ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম, এবং সম্ভবত তাদের সাহায্য করার জন্য অনেক বেশি চেষ্টা করতাম।”
আমি কামিলের কথাগুলো শুনে মুগ্ধ হয়েছি। যে ছেলে ক্যানাডার প্রাচুর্যের মধ্যে বড়ো হয়েছে তার মুখ থেকে আমি এরকম মন্তব্য আশা করিনি। আমি দোয়া করি কামিল এবং আমার অন্যান্য ছেলেমেয়ে ও নাতি নাতনিরা সকলে যেন ভালো মানুষ হয়, এবং আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর সৃষ্টির সেবায় নিজেদেরকে বিলিয়ে দেয় ।
এই প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই যে আমার ছ’টি নাতি-নাতনি সকলেই আমার কাছ থেকে বাংলাদেশের গল্প শুনতে ভালোবাসে। আমার সদ্য প্রকাশিত বাংলা বইখানার প্রায় সবটাই বাংলাদেশের গল্পে পরিপূর্ণ। আমার নাতনি আলিয়ার অনুরোধে আমি তার জন্য এখন ইংরেজি ভাষায় “Stories from the East and the West” শিরোনামের বইখানা লিখছি।
Kameel Khan
