সেদিন বরিশালের মর্জিনা আক্তার নামের একজন মহিলা আমাকে ভিডিও কল করলেন। তিনি ছিলেন আনন্দে উচ্ছসিত। ওই অবস্থায়ই তিনি আমাকে বললেন যে তার জীবনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে : তিনি এক কলেজে প্রফেসর নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি আরো বললেন যে তার এই সফলতা নাকি আমার জন্য সম্ভব হয়েছে।
আমি এখনো বুঝতে পারছিনা আমি কিভাবে তার সফলতায় জন্য দায়ী ছিলাম । আমি নাকি তাকে পড়াশুনা করতে উৎসাহ দান করেছি ও আর্থিক সহায়তাও করেছি। আসলে আমার এর কিছুই মনে পরেনা। আমি হাজার হাজার শিক্ষার্তীদের পড়াশুনার জন্য উৎসাহ জোগাড় করেছি, এবং এখনো করছি। তাদের অনেকেই পড়াশোনা ও জীবনের অন্যান্য ক্ষত্রে সফলতা অর্জন করেছে। আমার সদ্য প্রকাশিত বাংলা বইখানা লেখার প্রধান উদ্দেশ্য হলো আমাদের দেশের যুবক যুবতীদেরকে পরাশোনা করার জন্য অনুপ্রাণীত করা। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে বাংলাদেশের অনেক ছাত্রছাত্রীকে আর্থিক সাহায্য করার তৌফিকও দান করেছেন। তবে আমাদের প্রফেসর সাহেবাঁকে আর্থিক সাহায্য দেবার কথা আমার একটুকু মনে নাই ।
এখন আসি আসল কখায়। মর্জিনা আক্তার আমাদের গ্র্রামের বৌ। তিনি আমার সহপাঠীর প্রফেসর ছেলের স্ত্রী। তিনি যে জীবন যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন তা বাঙালি নারীর পক্ষে অসম্ভব মনে হয়। ক্লাস এইটে পড়া থেকে তার জীবন যুদ্ধ শুরু হয়েছে, এবং আজ অবধি সে যুদ্ধ চলছে । তার জীবনের পথচলা ছিল অনেক কঠিন। তার প্রথম যুদ্ধ ছিলো তার নিজের বাবার সাথে। মর্জিনা আক্তার মাশাল্লাহ দেখতে শোনতে সুন্দরী। তাই ক্লাস এইটে ওঠার সাথে সাথে তার বিবাহের প্রস্তাব আসা শুরু হলো। তার বাবা এই সময়ে তাকে বিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর হলেন । সৌভাগ্যবশত তিনি তার মা ও শিক্ষকদের সহায়তায় এই বিয়ের চাপ থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হন।
অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ার সময় একজন ভালো প্রফেসর ছেলের সাথে তার বিয়ে হয় । কিন্তু তার সুখ বেশিদিন টিকেনি । তার অল্প বয়সের ভাই মারা গেলো, তারা আর্থিক সংকটের সন্মুখীন হলেন, এবং দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় একটি কঠিন গর্ভাবস্থার পরে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হলো। শীঘ্রই তিনি আবিষ্কার করলেন যে তিনি তার সবচাইতে বেশি কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তার সন্তানটি নিয়ে i সে গুরুতর অটিজম নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। যাদের এই রোগটি সম্বন্ধে জ্ঞান আছে তারা জানে যে কোনো বাবা-মায়ের এ রকম সন্তান থাকলে তাদের জীবন শেষ। তাদেরও তাই হলো। এর পর কি হলো তা প্রফেসর সাহেবার কাছ থেকেই শুনি।
“আমাদের ছেলে মুনাম বড় হওয়ার সাথে সাথে ভাঙ্গাচুরা, জিনিসপত্র দেয়াল থেকে টেনে নাবিয়ে ফেলা, চিৎকার ইত্যাদি করতে লাগলো। সে বড় হওয়ার পর বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে অনেকবার হারিয়ে গিয়েছে। সে অনেকবার পানিতেও পড়েছে। আসে পাশের মানুষরা তাকে ডুবে মরে যাওয়া থেকে উদ্ধার করেছে। সে আমার উপর ১০০% নির্ভরশীল। একটা লতা যেমন গাছকে আঁকড়ে ধরে থাকে সে ও আমার শরিরের সাথে সবসময় ঝুলে থাকে। এমনকি আমার বাথরুম ব্যবহার করাও অসম্ভব হয়ে যায়।
“এই সময় আমার মনে হচ্ছিলো যে আমি একটি গভীর গর্তের অন্ধকার অতল গহ্বরে পড়ে গিয়েছি, এবিং সেখান থেকে আমি আর কোনো দিন উঠে আসতে পারবোনা। ঠিক এই সময় ড. আব্দুর রাব্ব এসে আমাকে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আলো দেখালেন। আমি সাহস করে আমার স্বামী ও বৃদ্ধ বাবাকে বরিশালে রেখে আমার ছেলে ও মাকে নিয়ে ঢাকা চলে যাই। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করেছি তখন আমার মা আমার ছেলের দেখাশোনা করেছেন । যেহেতু আমাদের আর্থিক সংস্থান সীমিত ছিল, তাই আমরা অন্য মেয়েদের সাথে শেয়ার করে একটা জায়গায় থামতাম। মুনাম এই মেয়েদেরকেও অনেক কষ্ট দিয়েছে। সে তাদের জিনিসপত্র ভেঙে ফেলতো এবং বইপত্র নষ্ট করে দিতো। আমার আর্টের উপর অনেক হোম ওয়ার্ক করতে হতো I আমার ছেলে সেগুলোও নষ্ট করে দিতো।
“আল্লাহ মেহেরবান আমার কষ্টের প্রতিদান দিয়েছেন। দীর্ঘ সাত বছর ঢাকায় পড়াশোনার পর আমি শিল্পকলায় বিএ. অঁনার্স, মাস্টার্স, এবং বি. এড ডিগ্রি শেষ করে মা ও ছেলেকে নিয়ে বরিশালে ফিরে আসি। আলহামদুলিল্লাহ, আমি এখন বরিশালের হোম ইকোনমিকস কলেজে অধ্যাপক হিসাবে কাজ করছি। আল্লাহ আমার স্বপ্ন পূরণ করেছেন।”
আমি মর্জিনা আখতারের অসামান্য কৃতিত্বের জন্য তাকে উপযুক্ত সম্মান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম্। আমি ভেবেছিলাম যে তার বিজয়কে প্রচার করলে সংগ্রামী নারীদের জন্য তিনি একজন উদাহরণ এবং অনুপ্রেরণার উৎস হবেন। আমাদের গ্রাম ও বরিশাল শহরের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে আমন্ত্রণ করা হলো। তাদের মধ্যে ছিলেন কয়েকজন কলেজ প্রিন্সিপাল, কয়েকজন হাই স্কুল ও প্রাইমারি স্কুল প্রধান, কর্পোরেশনের দু’জন কমিশনার, এবং আরো অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। আমি আমার ভাতিজা শাকিলকে আমাদের অতিথিদের খুব ভাল ভাবে আদর আপ্পায়নের বন্দোবস্ত করতে বলেছিলাম। আমাদের মেহমানরা খুব খুশি হয়েছেন। বেশ কয়েকজন বক্তা মর্জিনা আখতারের প্রশংসা করে বক্তিতা দিয়েছেন। আমরা তাকে একটি সুন্দর ক্যাশ উপহার দিয়েছি। । তিনি উপহার গ্রহণ করেন ও চূড়ান্ত বক্তিতা দিযে অনুষ্ঠান শেষ করেন। এই অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় আমাদের চহঠা গ্রামের আন্তঃধর্মীয় কমিউনিটি সেন্টার ও ফ্রী মেডিক্যাল সেবা ভবনে।