ইংরেজিতে একটা কথা আছে: “Spread good news because good news produces goodness.” সুসংবাদ প্রচার করুন কারণ সুসংবাদ মঙ্গল উৎপন্ন করে। আমার বন্ধুরা হয়তো লক্ষ্য করছেন যে আমি আমার লেখায় ভালো কথা বলতে চেষ্টা করি। আজ আমি আপনদেরকে একজন ভালো ছেলে সম্বন্ধে বলবো। বাংলার সকল মা-দের কাছে তাদের প্রত্যেকটা ছেলে একজন সোনার ছেলে। আমি এক ছেলেকে চিনি যে অন্যান্য ছেলেদের থেকে কিছুটা ভিন্ন। আমি বলবো সে আসলে একটা রত্ন।
সৈকত খুলনার এক গ্রামের ছেলে। সে লেখাপড়ায় ভালো। সে ইংরেজিতে অনার্স পরীক্ষা শেষ করে মাস্টার্স প্রোগ্রামের ক্লাশ শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। সে ভদ্র, অমায়ীক, বিনয়ী, বিশ্বস্ত ও শ্রদ্ধাশীল। মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের পর সে হয় বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেবে, না হয় অধ্যাপক বা সরকারি কর্মচারী হিসেবে কাজ করবে। এ পর্যন্ত সে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ তরুনদেরই একজন। তবে আমাদের দেশের বেশিরভাগ তরুণদের সাথে তার একটা তফাৎ আছে।
সৈকতের পরিবার স্বচছল। তাদের অনেক জমিজমা আছে। বাবা একজন সরকারি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গ্রামীণ ডাক্তার। তিনি আল্লাহরওয়াস্তে মানুষের চিকিৎসা করেন। তিনি তার সেবার জন্য এক পয়সাও নেননা। তিনি দিন রাত মানুষের সেবায় ব্যস্ত থাকেন। তার একটা ছোট ব্যবসাও আছে।
আমার মনে হয় সৈকতের মা একজন সুফী সাধক। তার ইবাদাত এবং আল্লাহর সৃষ্টির সেবা আমাকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে। তিনি একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। সৈকত তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।
সৈকতের পড়াশুনা ছাড়া আর কিছু করার দরকার হয়না। তবুও সে তার সমস্ত অবসর সময় কৃষিকাজ ও ঘর বাড়ির বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একদিন সে আমাকে টেলিফোনে বললো সেদিন সে তার করোল্লা ক্ষেতে কাজ করছে। সে আরো বললো যে তার ক্ষেতের সমস্ত করোল্লা একবারে তুললে সে দশ মনের মতো করোল্লা পাবে। আজ বাংলাদেশ সময়ের ভোরে আমাকে সে বললো ক্ষেতের এক অংশ থেকে সে ১৩৫ কেজি করল্লা তুলেছে এবং তা বিক্রি করার জন্য ঠেলাগাড়িতে নিয়ে ঠেলে বাজারে নিয়ে যাচ্ছে। আর একদিন আমি দেখি সে কোদাল দিয়ে মাঠের মাটি খুঁড়ছে। সময় পেলেই সে তাদের ঘেরের মাছের যত্ন নেয়।
অনেক বড়ো একটা জায়গার একদিকে আছে তার কলা গাছ ও সোজনা গাছের বাগান, এবং অন্যদিকে শীতের মৌসুমের বিভিন্ন রকমের শাক সবজি: টমেটো, শশা, সরিষা, ইত্যাদি। এই সমস্ত জায়গাটার মাটি ছিল লবনাক্ত কারণ তাদের বাড়ির কাছ দিয়ে বয়ে গেছে একটি লবনাক্ত পানির নদী। ফলে এই জমিতে কোনো ফসল হতোনা। তাই সৈকত এই জমি পুনরুদ্ধার করে ফসল উৎপাদন করার সিদ্ধান্ত নিলো। তার এলাকার লোকজন তাকে তা করতে নিরুৎসাহিত করেছিল কারণ তাদের মতে, সেসব ক্ষেতে কখনো কিছুই উৎপাদিত হতে পারে না। সইকত তার সিদ্ধান্তে ছিল অটল। সে লবনাক্ত জমির উপর গবেষণা করে, কৃষি বিভাগের সহায়তা নেয়, এবং চ্যানেল আই-এর শায়েক শিরাজের পরামর্শ অনুসরণ করে। পরিশেষে সে সেই জমি পুনরুদ্ধার করতে সফল হয় । এখন তার সেই জমির একদিকে আছে উপরোক্ত বাগানদুটো এবং অন্যদিকে অনেক রকম শাক সবজি। মজার বিষয় হল যে অন্যান্য লোকেরা এখন তার পদ্ধতি অনুসরণ করে তাদের নোনা জমি পুনরুদ্ধার করছে।
আমাদের বিশ্বাস করা কঠিন যে এই ছেলে তার মাকে সাহায্য করার জন্য মাটির চুলায় জ্বালানী কাঠ ব্যবহার করে খাবার রান্না করে, ঘর মুছে, এবং বাথরুম পরিষ্কার করে। তাদের একটা পশুপাখীর খামার আছে। সেখানে আছে ছাগল, রাজঁহাস, এবং বহু পাতি হাস ও মুরগি। প্রতিদিন তারা এক ঝুড়ি ডিম্ পায় । এর প্রায় সবটাই চলে যায় তাদের বাড়ির কাছের এতিমখানায়। সৈকত সমস্ত পশুপাখির যত্ন নেয়। এই সমস্ত পশুপাখীগুলোই নাকি সৈকতের পছন্দ করে কেনা।
সৈকত যে কৃষিকাজগুলো করছে তার প্রায় প্রত্যেকটা করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। সে কোদাল কাঁধে নিয়ে মাঠে যাচ্ছে; আমি লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে বলদ দুটোকে নিয়ে মাঠে হাল চাষ করতে যেতাম। সৈকত ঠেলাগাড়িতে করে করল্লা নিয়ে বাজারে যাচ্ছে তা বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে; আমি একটা বড়ো বেগুনের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে খালি পায়ে ইটের সুরকির রাস্তা দিয়ে খালি পায়ে চার মাইল হেটে সহরের বাজারে যেতাম বেগুন বিক্রি করতে। আমাদের দুজনের কাজের ভেতর তফাৎ হলো আমাকে এই কাজগুলো করতে হয়েছে নিজেকে ও আমার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, আর সৈকত তার কাজগুলো করছে কারণ এগুলো করতে সে ভালোবাসে। আমি তাকে আমার স্যালুট জানাচ্ছি।
আমি পাঠকদেকে নিশ্চিত করে বলতে পারি সৈকত জীবনে কোনোদিন কোনো কাজকে ছোট কাজ মনে করবেনা, এবং সে কোনোদিন সাধারণ কাজ করার মানুষদেরকে ঘৃণা করবেনা । সে সকল মানুষকে সন্মান ও শ্রদ্ধা করবে।
১. সৈকত ২. সৈকতের কাঁধে কোদাল। ৩. সৈকত গামছায় কাছা দিয়ে খালি গায়ে করল্লার বোঝা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। ৪. সৈকত করল্লা- বোঝাই ঠেলা গাড়ি ঠেলে বাজারে নিয়ে যাচ্ছে।